বিচিত্র গোয়ালপোখর

(১)
সবাই বলে বিডিও সাব 
ব্লক অফিসে থাকে, 
এগারোটায় গিয়ে দেখি 
কয়টা ছাগল ডাকে। 
কি আর করি তখন আমি 
কারেই বা আর ডাকি, 
এঘর ওঘর খুঁজে বেড়াই 
বিডিও আছেন নাকি। 
ছাগল তখন বলল আমায়, 
“তুইতো ভারি বোকা! 
বারোটা-একটার আগে এলে 
বিডিও পাবি কোথা! 
অফিসেতে নিয়ম করে 
এক ঘন্টা সে রয়, 
এরই মাঝে সময় করে 
লাঞ্চোটিফিন খায়।” 
আমতা আমতা বলি আমি, 
“জয়েন তো কেউ আছে? 
তাতেই না হয় চালাব কাজ 
যেতে চাই তার কাছে।” 
কথা শুনে ছাগল বাবু 
যেতেই লাগল হেসে, 
আমি ভাবি, ‘হাসির চোটে 
ভুঁড়ি না যায় ফেঁসে!’ 
থামলে হাসি বলল আমায়, 
“তুইতো ভারি বোকা! 
গোয়ালপোখর ব্লক অফিসে, 
জয়েন পাবি কোথা?” 
সত্যিই তো বোকা আমি 
এত কি আর বুঝি? 
কি যে করি, অবশেষে 
উপায় কিছু খুঁজি। 
পরিবারটা গরিব আমার 
দিন আনে দিন খায়, 
কাজ-কর্ম বন্ধ রেখে 
রোজ কি আসা যায়! 
কী আর করি তখন আমি 
না পাই দিশা কোনো 
এমন সময় ছাগল বাবু 
বলল আমায় ‘শোনো…’। 
“ভালো একটা পরামর্শ 
দিতে পারি তোরে, 
তোর কাজটা আমাকে দে 
দিচ্ছি আমি করে। 
তোর সমস্যা দেখে আমার 
কেঁদে উঠছে প্রাণ, 
তোর কাজটা করবই আমি 
খাওয়াবি একটা পান।” 
আমি বলি, “পান খাবেন? 
কী আর এমন কথা! 
একটা না হয় দুটোই আনি 
বলুন দোকান কোথা?” 
হেসে বলেন ছাগল বাবু 
“তুইরে ভারি বোকা! 
এ পান সে পান নয় রে খোকা!”

(২)
সবাই বলে শিক্ষক মশায়
বিদ্যালয়ে বাঁধা,
কিন্তু সেদিন গিয়ে দেখি
আছে কয়টা গাধা।
বলল হেসে একটা গাধা,
“তোর যে মোটা মাথা
এগারোটায় মাস্টার আসেন
কে বলল এই কথা?
জানিস তারা টিউশনিতে
কত ব্যস্ত থাকে?
বিদ্যালয়ে আসেন তারা
সুযোগ পেলে, ফাঁকে।
আসার আগেই যাওয়ার চিন্তা
যতটুকুও থাকে,
মোবাইল ফোনেই কাটায় সময়
কেই বা এসব দেখে!
ম্যানেজিং তো আছে তাদের
ভাগ-বাটোয়ার তালে
এসে খেয়ে পকেট পুরে
দিন যাচ্ছে চলে।
শুধু শুধু বকছি আমি
তোর যে মোটা মাথা
তোর মগজে ঢুকবে কি আর
এসব নিগুঢ় কথা!”
আমতা আমতা বলি আমি,
“রাগ কোরনা ভাই,
পড়াশোনার অবস্থাটা
একটু জানতে চাই।”
প্রশ্ন শুনে গাধা তখন
হেসেই কুটি কুটি,
“জানিস না তুই? স্কুল যে এখন
বারো মাসই ছুটি!”
“কি বললি? ও পরীক্ষা! (হাঃ হাঃ)
চিন্তা কিসের ভাই?
ফার্স্ট ডিভিশন পেতে শুধু
জেরক্স মেশিন চাই।”
“কেনই বা আর এসব কথা
বলছি তোমার কাছে,
মাথার ভেতর তোর যে শুধু
গোবর ভরা আছে।”

(৩)
সবাই বলে তেল-আটা দেয়
রেশন দোকান গেলে,
সেই ভরসায় একদিন আমি
আনতে গেলাম চলে।
গিয়ে দেখি, ডিলার তো নয়
হুতুম প্যাঁচা বসে,
ড্রাম্ব্যাগ হাতে আমায় দেখে
বলল একটু হেসে,
“কি কহিম আর হাসির বাত খান
হাসালো তুই মোরে,
হাতায় মিলবে চাউল-আটা
কে কহিল ফের তোরে?
( মানে : কি বলব আর হাসির কথা
হাসালি তুই মোরে,
রেশনেতে চাল-আটা দেয়
কে বলল তোরে? )”
আমতা আমতা বলি আমি
“শোনেন পেঁচক ভাই,
ঘরে আমার অভাব ভারি
দিন এনে দিন খাই।
বড়ই কষ্টে দিন গুজরান
বলব আমি কি আর,
খুব উপকার হত আমায়
দিতেন যদি জেআর।”
হুতুম তখন দাঁত কেলিয়ে
আমায় বলে, “শোনো,
মাথাটা তোর আছে খারাপ,
দিমাগ নেই তো কোনো।
তাইতো এসব আসল কথা
বলছি আমি তোকে
যে কয়টা জেআর আসে
নেয় সে বড়লোকে।
আরও কিছু শুনতে ইচ্ছা?
রেশন কোথায় যায়?
যতটুকু আসে হেথায়
প্রধান কিছু খায়,
ব্লক লেভেলেও আছেন কেহ
তারাও মারেন খোঁচা,
হুতুম আমি নইতো একা
ওরাও হুতুম প্যাঁচা।
খোঁচা-খুঁচির পরে রেশন
যেটুক থাকে পরে
হোলসেলেতে আমরা শেষে
দেই তা বিক্রি করে।
শুধু শুধু বলছি আমি
এসব কথা তোরে,
বেলা হল মেলা এবার
বকাস না আর মোরে।”

(৪)
সবাই বলে ডাক্তার বাবু
থাকেন হাসপাতালে,
সু-চিকিৎসাই ধর্ম তাহার
রোগ-বিরোগে গেলে।
বড় আশা বাঁচার আমার
একদিন আমি তাই
রোগ-জর্জর জীর্ন দেহে
হাসপাতালে যাই।
গিয়ে আমি এদিক-ওদিক
খুঁজে বেড়াই কত,
দেখি কিছু আরশোলা আর
মশা-মাছি যত।
ভন ভনিয়ে বেড়ায় উড়ে
চারদিকেতে ঘোরে
দু-একটার তো এমন সাহস
নাকের উপর’ও চড়ে।
রাগি আমি মনে মনে
মারব নাকি চড়!
ভেঙে যাবে নাকটা আমার
তাইতে লাগে ডর।
হাজার হলেও নিজের নাক তো
চাইনা দিতে ব্যাথা,
রাগ সামলে বলি, “ও ভাই
ডাক্তার বাবু কোথা?”
প্রশ্ন শুনে মশক তখন
ভনভনিয়ে বলে,
“ডাক্তার কি আর পাওয়া যাবে
হাসপাতালে এলে!
থাকেন তারা নার্সিং হোমে
কিংবা থাকেন বাড়ি
বুঝবি না তুই এসব ব্যাপার
তুই যে বোকার হাড়ি।”
লজ্জা পেয়ে বলি আমি,
“শোনেন মশক ভাই,
ওষুধ-পত্রের অবস্থাটা
একটু জানতে চাই।”
হাসতে হাসতে বলল মশায়
“শোনো ছেলের কথা!
গোয়ালপোখর হাসপাতালে
ওষুধ আবার কোথা?
কী জানতে চাস? ও আচ্ছা
শোন তাহলে কানে,
হাসপাতালের ওষুধ পাবি
সামনের ওই দোকানে।
এসব অতি গোপন কথা
বলে দিলাম তোরে
যা যাঃ এবার কেটে পড় তুই
জ্বালাস না আর মোরে।”

(৫)
সবাই বলে আইন মেলে
থানায় গেলে পরে
ধনি-গরীব নেই ভেদাভেদ
আইন সবার তরে।
তাইতো একদিন সাতসকালে
থানায় চলে যাই
বড় আশা নিয়ে মনে
আইন যদি পাই।
থানায় গিয়ে এঘর ওঘর
উঁকি মেরে দেখি,
খুঁজে পেলাম কোলা ব্যাঙ-কে
আইনকে না দেখি।
টেবিলটাকে করে বালিশ
বসে চেয়ার পরে
নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন
কোনের একটি ঘরে।
অবশেষে তাকেই আমার
দূঃখের কথা কই
গত রাত্রে হয়েছে মোর
‘পাকা ধানে মই।’
হাতে ধরি পায়ে ধরি
বলি ‘হুজুর’ ‘ছার’
‘এই এই ব্যাপার, দয়া করে
করুন উপকার।’
আর্থিক অবস্থাটা শুনে
ব্যাঙা তখন বলে,
“লাভ নেই রে এখানে তোর,
যা যাঃ বাড়ি চলে।
চাইলেই কি আইন মেলে,
না ফেললে কাড়ি?
নাকি, আইন ‘দুধ-ভাত’ আর
থানা ‘মামার বাড়ি?’
যত্ত সব ছোটো লোকের
আইন চেয়ে গোঁ,
তোদের জন্য থানায় একটু
ঘুমোবার নেই জো।
তুই যে একটা আস্ত বলদ
বুঝতে নেই আর বাকি,
তা নইলে আইন চাইতে
থানায় আসে নাকি!
সবই আজকাল টাকাতে হয়
টাকা ফেললে পরে,
আইন খোঁজার দরকার-ই নেই
আইন পাবি ঘরে।”
ধমক খেয়ে, ভয়ে বলি,
“বুঝিনি তো আমি,
তুচ্ছ এত জীবন আমার,
ঘুমটা আপনার দামি।”
কি করব আর অবশেষে
উপায় কিছু নাই,
দিশা-বিশা না পেয়ে
কবির বাড়ি যাই।

(৬)
সবাই বলে কবি মশায়
থাকেন ছিরিপুরে,
অনেক খুঁজেও পেলাম না তো
শুধুই এলাম ঘুরে।
আশে পাশের ন্যাতারা সব
বলল আমায় শোনো,
“আছে হেথায় ‘অ-কবি’ এক
কবি নেই তো কোনো।
কাজের মধ্যে দিন-রাত্তির
কাটে ঘোড়ার ঘাস,
মাঝে মধ্যে আমাদেরকে
দিতে চায় সে বাঁশ।
যতই আমরা বোঝাই তাকে,
শোনরে বোকা ছেলে,
দোষ নেই তো এতে কোনো
সরকারি মাল খেলে।
পাবলিক তো মরবেই রে,
না পেয়ে না খেয়ে,
তোর তা তাতে কী এসে যায়,
নে কিছু কামিয়ে।
যতই বলি, আয়না থাকি
আমরা রসে বসে,
মুখ ফিরিয়ে যায় সে চলে
একটু খানি হেসে।
ভাবো এবার একটু সে যে
কেমন বোকা ছেলে,
তা নইলে এমন সুযোগ
কেউ কি কভু ফেলে!
কিন্তু দেখি তোর মতনও
বোকা নেই আর দেশে
তা নইলে কেউ কি আবার
কবির খোঁজে আসে?”
বলি আমি, “নেতা সাহেব,
রাগ করবেন না দাদা,
সত্যি বলতে, ইয়ে মানে…
আমিও একটা গাধা।
বুঝি না তো অফিসারকে
কেমনে দেয় ঘুষ,
মিথ্যা কথাও পারি না তো
এমনি বোকা মানুষ।”
আমার কথায় নেতা তখন
আহ্লাদে আট খানা,
আমায় বলে, “তবে এবার
শোনো ব্যাপার খানা :
ভূ-ভারতে তোর মত যে
বোকা নেই আর এত,
তুই তো দেখি রায় চৌধুরির
গুপি গাইনের মত!”
মাথা আমার বিগড়ে গেল
গেলাম সবি ভুলে
কি যে হল কেমনে জানি
দিলাম তখন বলে :
“ঠিক বলেছেন, গুপিই আমি
বাঘা যেদিন পাব,
আপনার মত নেতাদেরকে
বারোটা বাজাবো।”

(অবশেষ)
বিচিত্র এই গোয়ালপোখর
বিচিত্র এর কল,
যা দেখিল দু-চোখে তাই
লিখিল নির্মল।
সবাই মিলে বল হরি,
হরি… হরি… বল।।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is Copyrighted !!